নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘আমার বাচ্চাকে বাঁচতে দেন। বাচ্চাটা মারা যাচ্ছে। একটি রাস্তা করে দিয়ে ওকে হাসপাতালে নিতে দিন।’ মুমূর্ষু সন্তানকে হাসপাতালে নেয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য একজন বাবার এমন আকুতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাসছে। পাশে রাস্তার ডিভাইডারে বসে মায়ের আর্তনাদÑ ‘আমার সোনামনি মারা যাচ্ছে। ওকে বিনা চিকিৎসায় মারবেন না। আপনাদের তো বাচ্চা রয়েছে। পায়ে ধরি আমার বাচ্চাকে হাসপাতালে নেয়ার সুযোগ দিন।’ গত ১৪ মে দুপুরে শাহবাগ মোড়ে সন্তানকে বাঁচানোর এক বাবা-মায়ের এই আর্তনাদ দেখেছে মানুষ। নার্সিং ডিপ্লোমাকে ডিগ্রি সমমানের করার দাবিতে ডিপ্লোমা নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ অবরোধ করেছিল। মুমূর্ষু সন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাবা-মায়ের অনুনয়-বিনয় আন্দোলনকারীদের হৃদয়ে সামান্য দয়া হয়নি। এমন দৃশ্য এখন রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে। যার সেখানে খুশি দাবি আদায়ের নামে রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করছে। নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কোনো প্রতিকার নেই।

গতকালও একদিকে কাকরাইল মসজিদের সামনের সড়কে আন্দোলন চলছিল। বেলা ১১টার পর থেকে কদম ফোয়ারা থেকে মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগ-কাকরাইল, শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন হয়ে কাকরাইল-প্রেসক্লাব, কাকরাইল চার্চ মোড় থেকে কাকরাইল মসজিদ হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগমুখী যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। যাত্রাবাড়ীর পাশে কাজলায় গ্যাসের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। এ ছাড়াও আরো কয়েকটি স্পটে মিছিল ও রাস্তা অবরোধ করা হয়। এর প্রভাবে ঢাকার বেশির ভাগ সড়কে যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়। তৈরি হয় তীব্র যানজট। তার সঙ্গে বিকেলে মুষলধারে বৃষ্টি মানুষের ভোগান্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

রাজধানী ঢাকায় ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি মানুষের বসবাস। দুই কোটিরও বেশি মানুষের এই মহানগরী এখন আন্দোলনের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ছোট-বড় যেকোনো ইস্যুতে মুহূর্তে উত্তাল হয়ে উঠছে ঢাকার রাজপথ। চলছে অবরোধ, সমাবেশ ও ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি। প্রায় প্রতিনিয়ত এসব কর্মসূচি ঘিরে ব্যস্ততম নগরীজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে অচলাবস্থা-জনভোগান্তি। তাতে যানজট যেমন বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনভোগান্তি। অসহনীয় এ অবস্থা থেকে মুক্তি কবে মিলবে, তা যেন জানা নেই কারোরই।

সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করা আছিয়ার ধর্ষণকারীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন, পলিটেকনিক্যাল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের আন্দোলন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন, জুলাই আন্দোলনে আহতদের আন্দোলন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, ডিপ্লোমা-ইন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি ডিগ্রি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন, প্রধান সড়কে অটোরিকশা চলাচল বন্ধের পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন, ইশরাক হোসেনকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বসানোর দাবিতে আন্দোলনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন দেখা গেছে। এসব আন্দোলনের ফলে যে ভোগান্তির তৈরি হচ্ছে, তা থেকে পরিত্রাণ চান সাধারণ মানুষ।

জুলাই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। আওয়ামী লীগ নেত্রী হাসিনা পালানোর পর ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর গত ৯ মাসেরও বেশি সময়ে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রতিদিন কয়েক ডজন কর্মসূচি চলেছে ঢাকায়। নানান দাবি-দাওয়া নিয়ে এসব কর্মসূচিতে কখনো ছাত্র, কখনো শিক্ষক, কখনো নার্স, কখনো বা রাজনৈতিক দল বা বিভিন্ন সংগঠন রাস্তায় নেমেছে।

গতকাল বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে কাকরাইল, মৎস্য ভবন ও আশপাশের এলাকায় তার সমর্থকদের অবস্থান নেন। ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত না আসায় নতুন কর্মসূচি পালন করছেন তার সমর্থকরা। মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগ-কাকরাইল, শাহবাগ থেকে মৎস্য ভবন হয়ে কাকরাইল-প্রেসক্লাব, কাকরাইল চার্চ মোড় থেকে কাকরাইল মসজিদ হয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগমুখী যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গতকাল ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থেকে বিভিন্ন মাধ্যমিক স্কুলের একদল শিক্ষক ঢাকায় আসেন। বেলা সোয়া ১১টায় তাদের বহনকারী আলম এশিয়া পরিবহনের বাসটি মৎস্য ভবনের সামনে আটকা পড়ে। তখন কিছু শিক্ষক হেঁটে চলে যান, বাকিরা আর যেতে পারেননি। পরে বেলা পৌনে ২টার দিকে বাসটি পেছনের দিকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে ঘুরে চলে যায়। সহিদুল ইসলাম নামে ওই বাসের একজন যাত্রী বলেন, ‘প্রায় আড়াই ঘণ্টা এক জায়গায় বসা। এইখানে প্রোগ্রামের কারণে আমাদের এমনিতেই দেরি হয়ে গেছিল। প্রোগ্রাম শেষ, এ কারণে আর যাইনি।’ মো. আলম এশিয়া পরিবহনের ঠিক পেছনেই ছিল মোহাম্মদপুর থেকে রামপুরা রুটের রমজান পরিবহনের দুটি বাস। ওই দুটো বাসও পরে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে চলে যায়।

একটি বাসের হেলপার আলমগীর হোসেন বলেন, কাকরাইল মসজিদের সামনে কেউ বাধা দেয়নি, গাড়ি এই দিকে ঢুকাইয়া দিসি। এরপর দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধইরা এইখানে বসা। যাত্রীরা সব নাইমা গেছে। এখন মগবাজার দিয়া ঘুইরা মোহাম্মদপুর যামু।’ ওই অটোরিকশার চালক সুলতান আলী বলেন, ‘সাড়ে ১১টায় ইসিবি থেকে রওনা হইছি। ১২টায় আসছি মহাখালী, সেখান থেকে জ্যাম ঠেলতে ঠেলতে দুই ঘণ্টার বেশি সময়ে এই পর্যন্ত আসতে পারলাম। এখন আর গাড়ি লড়ে না।’

নাঈমুল ইসলাম নামের এক পিকআপ চালক বলেন, ‘এই শহরে যাই কিছু হোক এর ফল ভোগ করে সাধারণ মানুষ। ইশরাকের সঙ্গে আসিফের ঝামেলা। ইশরাকের লোকজন আসিফের বাড়িতে গিয়া বইসা থাকুক। তা না করে রাস্তা বন্ধ করে মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে।’

বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে পূর্ব ঘোষিত লং মার্চ কর্মসূচি পালন করে শিক্ষকরা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাদের কর্মসূচিতে দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। এতে বেশ কয়েকজন শিক্ষক আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, জাতীয়করণের দাবি আদায়ে লং মার্চে অংশ নিতে সকাল থেকেই প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষকরা। এ সময় সড়ক বন্ধ হয়ে যায়।

জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা গতকাল আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন। এনসিপি নেতাদের কারণে সেখানে যানজটের সৃষ্টি হয়। এনসিপি নেতারা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ছাড়া এনসিপি কাউকে ভোটে অংশ নিতে দেবে না হুমকি দেন। ইসি এখন বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের মতো কাজ করছে বলে মন্তব্য করে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, আসিফ নজরুল ও সালেহউদ্দিনকে আমরা পদত্যাগ করতে বাধ্য করব। জনগণ যেভাবে আগের শাসকদের ছুড়ে ফেলেছে, আপনাদেরও ছুড়ে ফেলবে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ছাড়া এনসিপি কাউকে ভোটে অংশ নিতে দেবে না। ইসি এখন বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের মতো কাজ করছে।

গ্যাসের দাবিতে গতকাল কাজলায় হাত-মাইকে ঘোষণা দিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের মূল সড়কে (ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক) আসার আহ্বান জানান স্থানীয় কয়েকজন যুবক। বেলা ১১টার দিকে সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে কয়েকশ নারী-পুরুষ সড়কে নামলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এলে আন্দোলনকারীরা তাদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীরা জানান, মাসের পর মাস ধরে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ তারা নিয়মিত গ্যাসের বিল পরিশোধ করছেন। তারা আশপাশের সব সিএনজি রিফুয়েলিং পাম্পটি বন্ধের দাবি জানান। এক পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘প্রতিশ্রুতি’ পেয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কাজলা অংশ থেকে অবরোধ তুলে নেয় গ্যাসের দাবিতে আন্দোলনে নামা স্থানীয় বাসিন্দারা।

গত সপ্তাহেই রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে রাজপথে সরব হতে দেখা যায় ছাত্রদের দল এনসিপি। সেই কর্মসূচিতে ইসলামভিত্তিক দলগুলোও ব্যাপকভাবে সাড়া দেয়। শাহবাগ অবরোধের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ওই বিক্ষোভ কর্মসূচি একপর্যায়ে পৌঁছে যায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা পর্যন্ত। যমুনা ঘেরাওয়ের পর বিক্ষোভকারীরা মিন্টো রোডের পার্শ্ববর্তী হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বিপরীত পাশের সড়কে সমাবেশ করে। একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তেজগাঁওয়ে পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা যখন তখন সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছে।

ডিপ্লোমা-ইন নার্সিং এবং ডিপ্লোমা-ইন মিডওয়াইফারি কোর্সকে স্নাতক সমমানের স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন নার্সিং শিক্ষার্থীরা। একই দিন ৭০ শতাংশ আবাসন ভাতাসহ তিন দফা দাবিতে রাজধানীর কাকরাইল মোড় অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। তারাও টানা তিন দিন এ কর্মসূচি সমাবেশ ও গণ-অনশন করে। রাস্তা বন্ধ করে এসব কর্মসূচির ফলে সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছানো ও অসুস্থ রোগী নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়াসহ নানান ক্ষেত্রে ভোগান্তি বাড়ছে। নগরবাসীরা বলছেন, তারা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চান। তারা আর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়তে চান না। সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি ভুক্তভোগীদের।